বাওয়ারের পাঞ্চালী

দেরাদুন জেলায় আমাদের গ্রাম জৌনসার বাওয়ার৷ এ গ্রামে শুধু আমাদের উপজাতিদের বাস৷ দেরাদুন শহরটা কখনও দেখিনি৷ জেলার একেবারে উত্তরে খাড়া এবড়োখেবড়ো পাথরের পাহাড়ের গায়ে এলিয়ে আছে আমাদের গ্রাম৷ গ্রামের চৌহদ্দি বেশ বড়৷ কিন্তু মানুষের বাস খুব কম৷ পাহাড়ের গায়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে‍ মাঝে মাঝে কিছুটা ধাপে ধাপে ঝুম প্রথায় হয় আবাদ৷ মূলত ভুট্টা৷ সঙ্গে আদা এবং আরও কিছু ফলন৷ ধানও হয় সামান্য পরিমাণে৷ তবে গ্রামের বেশির ভাগটাই পাথুরে জমি৷ আবাদি জমি খুব কম৷ আবাদি জমি তাই দুর্মূল্য৷ গ্রামের পরিবারগুলি হতদরিদ্র৷ দু’বেলা পেট না চলার মতো৷ পরিবারগুলি ছোট ছোট অংশের জমিতে আবাদের ভরসায় চলে৷ কিছু পরিবার ভূমিহীন৷ তাদের জীবিকা পশুপালন৷ নির্মম দারিদ্রের কালো মেঘে ছেয়ে থাকে গোটা জৌনসার বাওয়ার গ্রাম৷ এ গ্রামে বাইরের লোকজন আসে না৷ দুর্গম পাহাড়ের গায়ে‍ অত্যন্ত সরু একজন চলার মতো পথে পায়ে হেঁটে‍ প্রায় ১৫ কিমি নীচে নামলে মেলে প্রথম ছোট জনবসতি৷ সেখানে একটু দূরে দূরে বসে দু’টি হাট৷ আমাদের গ্রামের পুরুষেরা পায়ে হেঁটে‍ সেখানে গিয়ে ভুট্টা আদা এবং অন্যান্য ফসল বিক্রি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে৷ আমাদের বাড়ির জমিতে যে ভুট্টা হয় তা দিয়ে সকলের পেট চলে না৷ তাই জমির ভুট্টা বিক্রি করা হয় না৷ গ্রামে বাড়ির সংখ্যা বেশি নয়৷ পাহাড়ের গায়ে গায়ে অনেকটা দূরে দূরে এক একটা বাড়ি৷ বাড়ি বলতে জরাজীর্ণ কাঠের ঘর৷ অনেকের তা-ও নয়৷ বাঁশ-সুপারি গাছ কেটে পরপর বসিয়ে একটা-দুটো ঘরের বাড়ি৷ গ্রামে জলের আকাল৷ জলের জন্য ভরসা পাহাড়ের গায়ের ঝরনা৷ আমার বাপের বাড়ির দু’ক্রোশ দূরে পাঙ্খীঝোরায় রয়েছে একটি ঝরনা৷ রোজ সকালে সেখানে গিয়ে বাঁশের লাঠির বাঁকে‍ টিনে করে জল আনতে হয়৷ শীতের সময় পাঙ্খীঝোরার ঝরনা শুকিয়ে যায়৷ তখন জলের খোঁজে‍ যেতে হয় আরও অনেকটা দূরে৷ রোজ সকালে আমাকে যেতে হতো পাঙ্খীঝোরায় ঝরনার জল আনতে৷

জৌনসার বাওয়ার গ্রামের পরিবারগুলির কারও হাতে দু’চার বিঘার বেশি জমি নেই৷ জমির আকাল৷ পরিবারগুলি সামান্য পরিমাণের জমিটুকু কিছুতেই ভাগাভাগি করতে চায় না৷ বংশ বৃদ্ধি হলে জমি ভাগ অবশ্যম্ভাবী৷ তাই জমি ভাগ রুখতে আমাদের উপজাতিদের মধ্যে একটা প্রথা চালু আছে৷ পরিবারের স্ত্রী ভাগ হবে৷ কিন্তু জমি ভাগ হবে না৷ এক পরিবারে যতজন ভাই, তাদের সবার স্ত্রী হয় একজন৷ স্ত্রীকে ভাগ করে রোখা হয় জমির ভাগ৷

ভায়েরা ভাগ করে ভোগ করে একজন স্ত্রীকে৷ পরিবারের সব ভাইদের একজন স্ত্রী৷ কাজেই ভাইদের সন্তানদের মাতৃপরিচয় জানা থাকলেও মুছে যায় পিতৃপরিচয়৷ ফলে এককভাবে পিতার জমি সম্পত্তির ভাগীদার কোনও সন্তান হতে পারে না৷ এক মায়ের সন্তান৷ তাই সন্তানেরা থাকে একান্নবর্তী৷ ফলে জমি ভাগ করতে হয় না৷ এই প্রথা চালু না থাকলে দু’এক প্রজন্মের মধ্যে কোনও পরিবারের ভাগে কয়েক হাতের বেশি পরিমাণ জমি থাকত না৷ এমন ব্যবস্থা চালু থাকায় বংশপরম্পরায় জৌনসার বাওয়ার গ্রামের পরিবারগুলির মধ্যে জমির পরিমাণ থেকে যায় অচ্ছেদ্য৷ সামান্য দু’চার বিঘা জমি ভাগ রোখার আর তো কোনও উপায়ও নেই৷ দুর্মূল্য সীমিত পরিমাণের জমিকে কি ভাগ করা যায়? যায় না৷ তাই সমাধানের সহজ রাস্তা জমির বদলে স্ত্রীকেই ভাগাভাগি করে নেওয়া৷ নারী তো সুলভ সম্পত্তি৷ আর তার কী মূল্য বা অধিকার৷ নারী সম্পত্তিকে তাই সহজেই ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়৷ এ গাঁয়ে বিবাহিত নারীদের অবস্থা দ্রুপদ রাজকন্যার মতো৷ তা হোক৷ তবুও তো আমরা একসঙ্গে একাধিক স্বামীর স্ত্রী হতে পেরেছি৷ কিন্তু জৌনসার বাওয়ার গ্রামের বহু মেয়েরই সেই সৌভাগ্যও হয় না৷ কারণ এক পরিবারের সব ভাই বিয়ে করে এক জন মেয়েকে৷ ফলে গাঁয়ে বিবাহযোগ্য পুরুষের আকাল৷ তাই গ্রামের সব মেয়েদের আর বিয়ের সুযোগ হয় না৷ যাদের বিয়ে হয় না তাদের অধিকাংশকেই নিয়ে যাওয়া হয় অনেক দূরে৷ কারও কাজ জোটে ডাল লেকে শিকারায়৷ ভ্রমণে আসা বাবুদের মনোরঞ্জনে৷ কারও কাজ জোটে হোটেল বা অন্য কোথাও৷ সারাদিন কাজ৷ রাতে বাবুদের শয্যাসঙ্গিনী৷ কিছু মেয়ে গ্রামেই থেকে যায় বাড়িতে বেগার খাটতে৷

আমি আসায় ঘরের এক পাশে সেলাই করা অনেকগুলো চট দিয়ে একটা পর্দা টাঙানো হয়েছে৷ না, আমার ঘর হিসেবে নয়৷ পঞ্চ স্বামীর পণ্য বউয়ের আবার আলাদা ঘর কীসের! চটের পর্দা ঘেরা অংশটি আমার নারীত্ব ভোগ করার জায়গা৷ রোজ রাতে এক স্বামী চটের পর্দার এক পাশে আমাকে ভোগ করবে৷ বাকি চার স্বামী থাকবে চটের ওপাশে৷ 

আমার নাম বাজো৷ তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়৷ ষোলোতেই আমার শরীরে যৌবন উছলে পড়েছিল৷ আমি দেখতে খুবই সুন্দরী৷ এ গাঁয়ের সকলেরই গায়ের রং টকটকে ফর্সা৷ আমার গায়ের ফর্সা রংয়ের ওপর যেন গোলাপ পাপড়ি লেপা৷ গালের দু’পাশ লালচে৷ শরীরের যৌবনের মতো মুখেও সবসময় উছলে পড়ে হাসি৷ হাসলে দু’গালে টোল পড়ে৷ রোজ সকালে একই ঘাঘরা কুর্তা আর মাথায় লাল রঙা ফেট্টি বেঁধে‍ ঘর থেকে দু’ক্রোশ দূরে পাঙ্ঘীঝোরায় যেতাম ঝরনার জল বাঁশের বাঁকে করে বয়ে আনতে৷ উল্টো দিক থেকে তিন ক্রোশ হেঁটে‍ জল নিতে আসত বিরজা৷ যতক্ষণ আমার জল নেওয়া না হত, দাঁড়িয়েই থাকত৷ তাকাত আমার মুখের এবং বুকের উদ্ধত যৌবনের দিকে৷ বুঝতাম ওর চাউনির অর্থ৷ চোখের তারা খেলিয়ে আমিও মাঝে মাঝে তাকাতাম ওর দিকে৷ প্রথম প্রথম দৃষ্টির বিনিময়৷ তারপর কথা শুরু৷ কোনও দিন আমার দেরি হলে বিরজা জল না ভরে দাঁড়িয়েই থাকত৷ বুঝতাম আমারই জন্য অপে‍ক্ষা৷ একটা অহংকার ছুঁয়ে‍ যেত আমার মনে৷ বর্ষায় কোনও কোনও দিন ঝরনা বেশি উত্তাল থাকলে বিরজা আমার খালি টিনে জল ভরে দিত৷ যাতে ঝরনার দাপটে পা হড়কে আমি পাহাড়ের খাদে পড়ে না যাই৷ জল ভরতে গিয়ে বিরজাকে না দেখলে আমারও খারাপ লাগত৷ আমার পরে যারা আসত তারা জল নিয়ে চলে গেলেও আমি অপে‍ক্ষায় থাকতাম বিরজার৷ আমি তখন সতেরো৷ বিরজা উনিশ৷ একদিন আমি পাঙ্খীঝোরার ঝরনার মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিলাম৷ হেসে উঠেছিল বিরজাও৷ বিরজাই একদিন বলেছিল, ‘আমাকে বিয়ে করবি?’ গোলাপ পাপড়ি লেপা আমার দু’গালে পড়েছিল আলতার প্রলেপ৷ দু’চোখ ঝরনার দিকে রেখে একটু নীচু করা আমার মুখে ছোট্ট খিলখিল হাসি৷ একটু দূরে গিয়ে ওর দিকে সরাসরি চোখ রেখে আমার মুখে আবার হাসি৷ বিরজার মুখেও পড়েছিল হালকা হাসি৷ টিন থেকে হাতের অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলাম ওর গায়ে৷ একটু দূরে দাঁড়িয়ে‍ দু’জন দু’জনের দিকে স্থির চোখে দেখেছিলাম৷

ততদিনে কথায় কথায় জেনেছি, আমাদের মতো ভূমিহীন পরিবার নয় বিরজারা৷ ওদের আছে তিন বিঘা জমিন৷ একে তো গাঁয়ে‍ মেয়েদের বিয়ে হওয়াই দুষ্কর৷ তার ওপর বিরজাদের রয়েছে তিন বিঘা জমি৷ জমিন থাকা পরিবারের বিয়ে‍-রীতি গাঁয়ের সবারই জানা৷ আমিও জানতাম৷ জমিন ভাগ করা হয় না৷ কিন্তু স্ত্রীকে ভাগ করা হয়৷ এক বাড়িতে সব ভাইদের জন্যে একজনই স্ত্রী৷ বিরজারা পাঁচ ভাই৷ পাঁচ ভাইয়ের তৃতীয় বিরজা৷ সব ভাইদের জন্য হবে একজন স্ত্রী৷ এ তো গাঁয়ের এবং আমাদের উপজাতিদের পরম্পরা৷ আমি এর বাইরে যেতে যাব কেন৷ বিরজাকে বিয়ে করলে আমি পাব পঞ্চ স্বামী৷ পাঁচ স্বামী আমার শরীরটা ভাগ করে ভোগ করবে৷ তা হোক৷ কিন্তু আমার মন তো ভাগ হবে না৷ আমার মনের পুরোটাই পাবে বিরজা৷ তা ছাড়া সতীনের সঙ্গে ঘর করার চেয়ে পাঁচ স্বামীকে নিয়ে ঘর করা অনেক ভাল৷ দু’বাড়ি‍র মধ্যে কথাবার্তা হয়ে যায়৷ বিরজাদের পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়৷ আমাদের বাড়িতে বয়ে যায় খুশির উছল হাওয়া৷ একে মেয়ের বিয়ে৷ তার ওপর জমিন পরিবার৷ হোক পাঁচ স্বামী৷ এটা তো আমাদের সমাজের রীতি৷ মেয়েদের মনের খোঁজ কেউ নেয় না৷ ভাবখানা মেয়েদের আবার মনের কী আছে! ঘাড় থেকে একটি মেয়ের বোঝা নামছে৷ এটাই তো বড় কথা৷ মন-টনের আবার কী মূল্য! দ্রৌপদী ছিল রাজনন্দিনী৷ তারও তো ছিল পঞ্চস্বামী৷ শাশুড়ির কথায় নিজেকে ভাগ করে নিয়েছিল পঞ্চ ভ্রাতাদের কাছে৷ আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম হোক আমার পঞ্চ স্বামী৷ কিন্তু বিরজাকে তো পাব৷ হতে পারব একজন বিবাহিত নারী৷ আমাদের সমাজে সে তো পরম কাঙক্ষিত এবং সৌভাগ্যের৷

আমাদের বাড়ির বাঁশের চাটাইয়ের মেঝে, সুপারি গাছ এবং বাঁশের দেওয়ালের দুটো ঘরের সামনে উঠোনে হয়েছিল বিয়ের আয়োজন৷ আমার বাবা একটা ছাগল বেচে জুগিয়েছিল বিয়ের টাকা৷ উঠোনে এক পাশে পাতা ছিল পরপর পাঁচটি পিঁড়ি‍৷ উল্টোদিকে‍ মুখোমুখি পাতা ছিল একটি৷ চাপকান পাঞ্জাবি কোমরে ফেট্টি মাথায় হলুদ পাগড়ি পরে পাঁচ পিঁড়িতে‍ বড় থেকে ছোট পরপর বসেছিল ওরা পাঁচ ভাই৷ কিশেন, গুঙ্গা, বিরজা, বৈজা এবং নানকু৷ উল্টো দিকের পিঁড়িটায় বসেছিলাম আমি৷ এক পাশে জ্বলছিল কয়েকটি কাঠ৷ আমার মুখ ছিল নীচু৷ আমার স্বামীদের মুখ দেখিনি৷ তবে দু-তিনবার একটু ওপরের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলাম বিরজার দিকে৷ ওর চোখের দৃষ্টিও আমার দিকে৷ যেন হয়ে যায় শুভদৃষ্টি৷ ওদের পাঁচ ভাইয়ের মুখোমুখি বসেছিলাম আমি একা৷ আমার তখন একটু গর্বও হয়েছিল৷ যেন আমি রয়েছি স্বয়ম্বর সভায়৷ আর ওরা পাঁচজন প্রতীক্ষায় আমাকে পাওয়ার জন্য৷ আমাদের গাঁয়ের বিয়েতে কোনও পুরোহিত থাকে না৷ মন্ত্রোচ্চারণ হয় না৷ শুধু আগুন থাকে সাক্ষী৷ ভাবখানা– অত ভড়ংয়ের কী দরকার৷ নিতে এসেছি ভোগের সামগ্রী৷ তাকে নিয়ে যাব৷ তার জন্য আবার আচার অনুষ্ঠানের কী প্রয়োজন৷ আগুনকে সাক্ষী রেখে শুধু মালা বদলের মাধ্যমে হয়ে যায় বিয়ে৷ আমি পিঁড়িতে‍ দাঁড়িয়েছিলাম৷ ওরা বড় থেকে ছোট পাঁচ ভাই একে একে এসে আমার গলায় পরিয়ে দেয় মালা৷ এরপর ওরা পাঁচ ভাই ওদের নির্দিষ্ট পিঁড়িতে‍ পরপর দাঁড়িয়ে‍ থাকে৷ আমি সবার সামনে গিয়ে পরপর ওদের গলায় পরিয়ে দিই মালা৷ শাঁখ বাজল না৷ হইচই হাসি ঠাট্টা হল না৷ কোনও বাদ্যি বাজল না৷ শুধু হলো উলুধ্বনি৷ আমার বিয়ে হয়ে গেল৷ আমি পেলাম পাঁচ স্বামী৷ ওরা পেল এক বউ৷ ওদের সঙ্গে রওনা দিলাম শ্বশুরবাড়ি৷ পাহাড়ের গায়ে একজন চলার মতো সরু এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথে পাঁচ ক্রোশ হেঁটে‍ পৌঁছতে হয় শ্বশুরবাড়ি৷ বড় থেকে ছোট ওরা পাঁচ ভাই৷ সবশেষে আমি৷ আমার হাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি৷ আমার জামাকাপড় টুকিটাকি জিনিস৷

প্রথম দেখলাম শ্বশুরবাড়ি৷ মন ভরে গেল৷ আমাদের মতো বাঁশ সুপারি গাছের দেওয়ালের ঘর নয়৷ কাঠের বাড়ি, যদিও জরাজীর্ণ৷ তবুও কাঠের ঘর তো৷ গর্ব হল৷ পাঁচ স্বামীর পিছে পিছে বাড়ির উঠোনে পা দিলে দু’চারজন প্রতিবেশী এগিয়ে এল৷ উলুধ্বনি হল৷ কোনও বরণডালা নয়৷ আরতি করার মতো আমার মুখের চারপাশে প্রদীপের শিখা ঘুরিয়ে আমাকে বাড়ির বউ হিসেবে বরণ করল শাশুড়ি৷ পাঁচ স্বামী আমার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে৷ শাশুড়ি হাত ধরে নিয়ে গেল একটা ঘরের কোণে৷ সেখানে সিঁদুর মাখা একটা পাথরকে দেখিয়ে শিব ঠাকুরকে প্রণাম করতে বলল৷ দু’জন বয়স্ক লোকের সামনে আমাকে এনে বলল, ‘এরা তোমার দুই শ্বশুর৷ আমার দুই স্বামী৷’ আমি একে একে প্রণাম করলাম আমার দুই শ্বশুর, শাশুড়ি এবং পাঁচ স্বামীকে৷ পঞ্চম স্বামী নানকু আমার চেয়ে ছোট৷ কেমন একটা লাজুক ভ্যাবাচ্যাকা মুখে আমার প্রণাম নিয়েছিল৷ আমার ফিক করে হাসি পেয়ে গিয়েছিল৷ বরণ পর্ব মিটে যাওয়ার পরে শাশুড়ি বলেছিল, ‘তোমার পাঁচ স্বামীস৷বাইকে সমানভাবে দেখবে৷ সমানভাবে কাছে নেবে৷’ যেন কুন্তির কণ্ঠস্বর৷ পাঁচ পুত্রের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যা এনেছ সমানভাগে ভাগ করে নাও৷’

আমি জানতাম না৷ শাশুড়ি বলেছিল, ‘তোমার স্বামীদের বাবারা দু’ভাই৷ আমারও বিয়ে হয়েছে দু’ভাইয়ের সঙ্গে৷ পালা করে দু’ভাইয়ের শয্যায় প্রতি রাতে আমি শুয়েছি৷ তোমার স্বামীদের কার বাবা কে তা কেউ জানে না৷ আমিও না৷ সবাই শুধু জানে তোমার স্বামীরা এক মায়ের এবং দুই বাবার সন্তান৷’

প্রতি রাতে অন্য স্বামীরা আমার শরীরকে ফালা ফালা করে যখন কর্ষণ করত, তখন আমার মনে ভেসে উঠত বিরজার মুখ৷ বিয়ের এক বছর পর আমি মা হয়ে যাই৷ আমার কোলে আসে ছেলে গুড্ডু৷ কে গুড্ডুর বাবা আমি জানি না৷ আমার মন বলত বিরজাই গুড্ডুর বাবা৷ বিরজা যখন আমার সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মত্ত থাকত তখন আমি মনে মনে ভাবতাম আমি মা হয়ে যাব৷

আমার ওপর স্বামীদের সমান অধিকার থাকলেও আমাকে ভোগের পদ্ধতিটাও ঠিক করে দেয় শাশুড়ি৷ প্রথম রাতে আমার সঙ্গে শোবে জ্যষ্ঠে স্বামী কিশেন৷ এরপর প্রতি রাতে বড় থেকে ছোট স্বামীরা শোবে আমার সঙ্গে৷ আবার বড় থেকে ছোট৷ এমনিভাবে পালা করে প্রতি রাতে আমার ওপর চলবে স্বামীদের অধিকার ফলানো৷ আমার ফুলশয্যা হল না৷ ভাবখানা ফুলশয্যা আবার কিসের? এক শয্যায় শুয়ে প্রথম নারী সম্ভোগ৷ এতে আবার ফুলের কী ভূমিকা৷ আমার সাধ ছিল প্রথম রাতে বিরজার সঙ্গে শোওয়ার৷ বিরজার কাছে চেয়েছিলাম কুমারী থেকে নারীত্বে রূপান্তরিত হতে৷ কিন্তু আমি তো পাঁচ ভাইয়ের পণ্য বউ৷ আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশের সুযোগ কোথায়৷

এ বাড়িতে জোড়াতালি দেওয়া দুটো লম্বাকৃতির ঘর৷ একটা ঘরে বাস আমার দুই শ্বশুর ও শাশুড়ির৷ সে ঘরেই এক পাশে রান্না কাওয়ার ব্যবস্থা৷ শিবঠাকুর নামে পাথরটার ঠাঁই সে ঘরে রান্নার জায়গার উল্টোদিকের এক কোণে৷ মাঝের অংশে থাকে দুই শ্বশুর-শাশুড়ি৷ দ্বিতীয় ঘরটি আমার পাঁচ স্বামীর৷ আমি আসায় ঘরের এক পাশে সেলাই করা অনেকগুলো চট দিয়ে একটা পর্দা টাঙানো হয়েছে৷ না, আমার ঘর হিসেবে নয়৷ পঞ্চ স্বামীর পণ্য বউয়ের আবার আলাদা ঘর কীসের! চটের পর্দা ঘেরা অংশটি আমার নারীত্ব ভোগ করার জায়গা৷ রোজ রাতে এক স্বামী চটের পর্দার এক পাশে আমাকে ভোগ করবে৷ বাকি চার স্বামী থাকবে চটের ওপাশে৷

দেরাদুনের একেবারে উত্তরে পাহাড়ি গ্রামে অসম্ভব ঠান্ডা৷ বিশেষ করে রাতে৷ কারও তেমন শীত বস্ত্র নেই৷ এক ছেঁড়া ফাটা ছোট কম্বল সারাদিন গায়ে দিয়ে থাকা৷ রাতে সেটাই জড়িয়ে শুয়ে পড়া৷ খাট নেই৷ কাঠের মেঝেতে চটের ওপর পাতলা ছেঁড়া একটা চাদর পেতে শোওয়া৷ ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ঘরে লোহার কড়াইয়ে জ্বলে কাঠ৷ চারদিক জঙ্গলে ছাওয়া৷ কাঠের অভাব নেই৷ জঙ্গল থেকে কেটে আনলেই হয়৷ ঠান্ডায় গায়ে দেওয়ার জন্য আমার কম্বল নেই৷ স্বামীদের ভাবখানা আমারই তো ওকে গরম করে রাখব৷ কম্বলের কী দরকার! প্রথম রাতে আমার সঙ্গে শুতে আসে জ্যেষ্ঠ স্বামী কিশেন৷ ঘরের চটের পর্দা ঘেরা অংশে মেঝেতে পাতা চাদরের ওপর বসে আমি ঠকঠক করে কাঁপছি৷ কাঠের আগুনের পাশে বসে শরীরে তাপ নিচ্ছি৷ বড় স্বামী কিশেন চটের পর্দা সরিয়ে ঘরের ওপাশ থেকে আমার কাছে আসে৷ কাঠের আগুনের আবছা আলোয় আমার দিকে এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘তুই বেশ সুন্দরী৷ বিরজার পছন্দ আছে৷’

আমি নত মস্তকে৷ বুকের ভেতরের ধড়ফড়ানি কানে বাজছে৷ স্বামী এগিয়ে এল আমার সামনে৷ বলল, ‘তোর ঘাগরা কুর্তা খুলে ফেল৷ তোকে ভাল করে দেখি৷’

আমার অপে‍ক্ষায় না থেকে বড় স্বামী খুলে ফেলল আমার কুর্তা ঘাগরা৷ আমাকে শুইয়ে দিল৷ ঝাঁপিয়ে‍ পড়ল আমার ওপর৷ আদিম আনন্দ তার শরীরের ভঙ্গিমায়৷ কাঠের আগুনের আবছা আলোয় স্বামীর মুখের দিকে তাকাতে পারিনি৷ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল বিরজার ম্লান মুখ৷ বিরজার জন্য কষ্ট হচ্ছিল৷ আমাকে ভোগ করার নানারকম শব্দ বেরোচ্ছিল বড় স্বামীর মুখ থেকে৷ নিশ্চয়ই সেসব শুনতে পাচ্ছিল চটের পর্দার ওপাশে থাকা বিরজা৷ওরও নিশ্চয়ই তখন কষ্ট হচ্ছিল আমার মতো৷ সারারাত শরীরকে ব্যস্ত রেখে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে কিশেন৷ আমার নিস্তেজ শরীরটাও ঢলে পড়ে ঘুমে৷

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না৷ ভোরবেলা ঘরের বাইরে থেকে শাশুড়ির ডাক, ‘বাজো, বাজো৷ বেলা হল৷ বাড়ির বউয়ের কি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে চলে?’ ধড়ফড় করে উঠে বসি৷ কুর্তা ঘাগরা পরে তাড়াতাড়ি বাইরে আসি৷ শাশুড়ি বলে, ‘বাড়ির বউকে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে নেই৷ চোখমুখ ধুয়ে একটা রুটি কেয়ে পাঙ্খীঝোরা থেকে জল নিয়ে আয়৷’

জল আনার পর ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করা৷ উঠোন ঝাড় দেওয়া৷ জাতায় ভুট্টা বাঙা৷ জঙ্গল থেকে কাঠ আনা৷ রান্না করা৷ অনেকটা বেলা পর্যন্ত আমার ফুরসত নেই৷ স্নান করে শ্বশুর, স্বামীদের খেতে দেওয়া৷ তারপর শাশুড়ির সঙ্গে খাওয়া৷ বিকেলেও বিশ্রাম নেই৷ স্বামীরা মাঠ থেকে আদা, ভুট্টা আনলে গুছিয়ে ঘরে তোলা৷ সন্ধ্যায় শ্বশুরদের পা টিপে দেওয়া৷ সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়৷ রাতের রান্না৷ সবাইকে খেতে দেওয়া৷ বাসন মেজে গুছিয়ে রাখা৷ কাজে কাজে সারাদিন যখন কেটে যায় তখন আমার হাঁফ ধরে যায়৷ স্বামীরা নির্বিকার৷ ভাবখানা বউ করে এনেছি যখন তখন সারাদিনের দাসত্ব তো তোমার দায়৷ দাসীর আবার বিশ্রামের কী!সন্ধে বেশ গাঢ় হলে দুটো ভুট্টার রুটি খাওয়া৷ সবার খাওয়ার পর একটু সব্জি জুটলে ভাল৷ না জুটলে নেই৷ খাওয়ার পর শরীর এলিয়ে যায়৷ তখন ডাক পড়ে স্বামীদের দেহ ক্ষুধা মেটাতে৷ যেতে একটু দেরি হলে ধমক ধামক মুখ ঝামটা৷ আমার দৈনন্দিন দিবারাত্রির কাব্য৷ কাউকে বলার নেই৷ শোনারও কেউ নেই৷

রাতে‍ বিরজা বাদে সব স্বামীদের আচরণ একই রকম৷ বিশেষ কথা বলে না৷ আমার কথাও জানতে চায় না৷ শুধু আমার শরীরটাতেই আগ্রহ৷ যতক্ষণ তৃপ্ত না হয় আমার শরীরটাকে যেন লাঙলের ফলায় ফালা ফালা করতে থাকে৷ পিষতে থাকে৷ তারপর তৃপ্ত হলে ঢলে পড়ে ঘুমে৷ আমার মনের খোঁজ কেউ নেয় না৷ হুকুম করা ছাড়া কেউ কথাও বলে না বিশেষ আমার সঙ্গে ভাবখানা পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী সম্পত্তি করে এনেছি৷ সারাদিন গতর খাটবে৷ রাতে গতর দেবে৷ এর বাইরে তো তোমার আর কিছু চাওয়ার নেই৷ ছোট স্বামী নানকু যে রাতে আমার প্রথম সঙ্গে শুয়েছিল সেদিন ওর অবস্থা দেখে আমি মজা পেয়েছিলাম৷ আমার চেয়ে বয়সে ছোট৷ ১৬ বছর বয়স৷ আমার শরীর নিয়ে ওর আনাড়িপনা দেখে হাসি পেয়ে যায়৷ এক সময় আমিই ওকে আমার উন্মুক্ত বুকের ওপর জাপ্টে ধরেছিলাম৷ যেন ছোট খোকাকে মায়ের আদর৷ সেই নানকুও দু-তিন রাতের মধ্যে দাদাদের মতো আমাকে ভোগ করায় অভ্যস্ত হয়ে যায়৷ একমাত্র বিরজা যে রাতে আমার সঙ্গে শুত সে রাতে আমি একটা অন্যরকম স্বাদ পেতাম শরীরের সঙ্গে মনেও৷ শুয়েই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত না বিরজা৷ আমাকে সোহাগ করত৷ শরীরের সঙ্গে মনও ভরে যেত আমার৷ মনে হতো আজকের রাতটা যেন অনেক দীর্ঘ হয়৷ আমার সঙ্গে পুটুর পুটুর গল্পও করত বিরজা৷ সারাদিন তো কাজের কথা ছাড়া স্বামীদের সঙ্গে কথা হত না৷ প্রতি রাতে অন্য স্বামীরা আমার শরীরকে ফালা ফালা করে যখন কর্ষণ করত, তখন আমার মনে ভেসে উঠত বিরজার মুখ৷ বিয়ের এক বছর পর আমি মা হয়ে যাই৷ আমার কোলে আসে ছেলে গুড্ডু৷ কে গুড্ডুর বাবা আমি জানি না৷ আমার মন বলত বিরজাই গুড্ডুর বাবা৷ বিরজা যখন আমার সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মত্ত থাকত তখন আমি মনে মনে ভাবতাম আমি মা হয়ে যাব৷ মা হওয়ার পরেও আমার দিনলিপি বদলায়নি৷ সেই সারাদিন খাটা৷ রাতে স্বামীদের দেহ ভোগের পণ্য হওয়া৷ বিরজার প্রতি আমার বাড়তি অনুরাগ ও ভালবাসা প্রকাশের কোনও সুযোগ বা ফুরসত মিলত না৷ কারণ আমি পাঁচ ভাইয়ের সমান স্ত্রী৷ গুড্ডুকেও কাছে পাওয়ার সুযোগ কম৷ বেশির ভাগ সময় চার মাসের গুড্ডু থাকত শাশুড়ির কাছে৷

আমাদের জমিতে এবার আদার ফলন ভালো হয়েছে৷ স্বামীরা খুশি৷ একদিন আদার বোঝা মাথায় নিয়ে বিক্রির জন্য ঘর থেকে বেরোয় স্বামীরা৷ প্রায় পনেরো কিমি সরু পাহাড়ি পথে হেঁটে‍ নীচে নেমে‍ ওরা যাবে পাশাপাশি দুই হাটে৷ একটি হাটে যাবে বিরজার সঙ্গে নানকু৷ অন্য হাটে বাকি তিন ভাই৷ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা রওনা দেয়৷ আমি দু’টো পুঁটলিতে দু’দলের হাতে ধরিয়ে দিই ভুট্টার রুটি আর সব্জি৷ পড়ন্ত বিকেলে প্রথমে ফিরে আসে বিরজা আর নানকু৷ নানকু চলে যায় পাঙ্খীঝোরায় স্নান করতে৷ বিরজা আমাকে ডেকে নিয়ে যায় স্বামীদের ঘরে৷ একটা পুঁটুলি খুলে কাগজের মোড়ক বের করে৷ তার থেকে বের করে‍ আমার সামনে মেলে ধরে একটা নতুন হলুদ ঘাগরা এবং লাল রঙা কুর্তা৷ ঘাগরায় গোল গোল কাচ বসানো৷ আমার চোখে খেলে যায় খুশির ঝলক৷ আমার দুটো রঙিন রং চটা কুর্তার পিঠের দিকে‍ অনেকটা ছিঁড়ে‍ গেছে৷ বিবর্ণ ঘাগরা দুটোয় জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে৷ স্বামীরা ভ্রূক্ষেপ করে না৷ ভোগের পণ্যের আবার লাজলজ্জার কী আছে! কিন্তু বিরজা আমার জন্য ভেবেছে৷ মন আমার পুলকিত৷ কিন্তু স্থায়িত্ব পায়নি৷ একটা ভয় আমার মনের মধ্যে ঠোক্কর দিতে থাকে৷ অন্য স্বামীরা কী বলবে নতুন ঘাগরা কুর্তা দেখে৷ ওরা কি জানে বিরজা আমার জন্যে আনবে নতুন ঘাগরা কুর্তা? বিরজাকে আশঙ্কার কথা বলতে সে পাত্তা দিল না৷ বলল, অন্য ভাইদের বুঝিয়ে বলবে, আমার দুটো ঘাগরা কুর্তা ছিঁড়ে‍ গেছে৷ তাই নতুন কিনে এনেছে৷ আমার মনের মথ্যে তবু ভয়৷ বিরজা কিন্তু খুশিতে ডগমগ৷ বলল, ‘নতুনগুলো পর৷’

অন্য স্বামীদের না জানিয়ে আমি পরতে চাইছিলাম না৷ বিরজা জোর করতে লাগল৷ আমাকে অভয় দিল, ‘তোর ভয় কী? যা বলার আমি বলব৷’

বিরজার উৎসাহে আর বাধা দিতে পারিনি। পরে নিই নতুন ঘাগরা আর কুর্তা। আমাকে দেখে বেজায় খুশি বিরজা। নতুন ঘাগরা কুর্তা পরার চেয়ে আমার প্রতি বিরজার ভালবাসা ও অনুরাগে আমি বেশি আপ্লুত। বিরজা আমাকে একটা চুমু খেল।

আমার পেটের ওপর হাঁটু চেপে কিশেন খুলে ফেলল ঘাগরার ফিতের বাঁধন। পায়ের দিক নীচে টেনে খুলে ফেলল ঘাগরা। পটপট ছিঁড়ে ফেলল কুর্তার সব হুক। ছিঁড়ে গা থেকে খুলে দিল কুর্তা। যেন দ্যূতসভায় দুঃশাসনের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। আমার কোনও কৃষ্ণসখা নেই। লজ্জাহরণ রোধ হল না। স্বামীদের সামনে বিবস্ত্র হতে লজ্জা থাকবে কেন? ভাবখানা এমন। দৃশ্য দেখে আমার দুই শ্বশুরের মুখ নীচু। যেন দ্যূতসভায় পাঞ্চালীর অপমানে আনত মুখে পিতামহ ভীষ্ম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্যরা। আমার শাশুড়ির চোখ ঢাকা আঁচলে। যেন পুত্র দুঃশাসনের অপকর্ম দেখে লজ্জায় চোখ বাঁধা গান্ধারী।

এক সময় জানলা দিয়ে দেখি আমার বাকি স্বামীরা হাট থেকে ফিরে আসছে। স্মিত হাসিমুখে বিরজার দিকে চোখের তারা খেলিয়ে নতুন ঘাগরা কুর্তা পরে আমি ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। স্বামীদের জন্য রুটি বানাতে। ছোট ছোট ঢেউ তোলা নদীতে দুলে দুলে চলা নৌকোর মতো খুশির দোলা আমার শরীরে মনে। আমার রুটি তৈরি হয়ে গেল। একটু জিরিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পাঁচ স্বামী এল খেতে। পাঁচ স্বামীর জন্য পাঁচটি থালায় দিলাম রুটি সব্জি। খাওয়া শুরু করতে যেতেই কিশেনের দৃষ্টি আমার দিকে। মুখে গুঁজে দেওয়ার বদলে হাতের রুটির টুকরো নেমে এল থালায়। গোল গোল অবাক চোখের দৃষ্টি আমার দিকে। আমি লাজুক মুখ। কিশেন জানতে চাইল এই ঘাগরা কুর্তা কে দিল। আমি বিরজার দিকে চোখ রাখলাম। কিশেন তাকাল বিরজার দিকে। জিজ্ঞেস করল, ‘নতুন ঘাগরা কুর্তা কোথায় পেলি?’

বিরজা মৃদুস্বরে বলল, ‘হাটে আদা বেচে কিনেছি।’

‘আদা বিক্রির পয়সা কি ঘাগরা কেনার জন্য’- কঠিন স্বর কিশেনের।

দাদাকে ওরা ভয় পায়। বিরজা মিউমিউ করে বলল, ‘ওর ঘাগরা কুর্তা ছিঁড়ে গেছে।’

দাদা ধমকে উঠল, ‘সেটা আমরা সকলে বুঝব। তুই ঘাগরা কেনার কে।’

আমি ভেবেছিলাম বিরজা হয়তো বলবে, ‘আমি শখ করে কিনে এনেছি।’ আমার প্রতি ওর ভালবাসা প্রকাশ পাবে। বিরজা তা বলল না। বরং আমার ওপর দোষ চাপিয়ে বলল, ‘আজ হাটে যাওয়ার সময় ও বায়না করে বলেছিল, একটা ঘাগরা কুর্তা আনতে।’

শুনেই আরও ক্ষিপ্ত কিশেন। বিরজার কথা শুনে আমি অবাক। আমাকে ভালবেসে ঘাগরা কুর্তা কিনে আনার কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না। অন্য স্বামীদের চেয়ে বিরজা আমাকে বেশি ভালবাসে একথা প্রকাশ করার মুরোদ ওর হল না। নাকি বিরজাও আসলে চায় আমার ওপর সব স্বামীদের সমান অধিকার। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম বিরজার মুখের দিকে। আনত মুখে ওর দৃষ্টি মাটির দিকে। কিশেন রুটির থালা ফেলে চলে আসে আমার কাছে। রাগত স্বরে বলল, ‘কেন তুই বিরজার কছে ঘাগরার বায়না করেছিস? বিরজা কি তোর বেশি আপন? তোর ওপর আমাদের পাঁচ স্বামীর সমান ভাগ। সমান অধিকার। তুই কি সেটা ভাঙতে চাস? তোকে নিয়ে ভাইদের মধ্যে ভাগাভাগি করাতে চাস?’

উনুনের কাঠের আগুনের চেয়ে গনগনে চোখ কিশেনের। আমার মুখে কোনও কথা নেই। কিশেন এগিয়ে এসে বাঁ হাত বাড়িয়ে আমার চুলের মুঠি ধরল। হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে এল ঘরের বাইরে। চালাতে লাগল আমার ওপর কিল চড় ঘুষি। বাকি চার স্বামী ঘরের বাইরে এসে আমার একপাশে পরপর দাঁড়িয়ে প্রহার দেখছে। উল্টোদিকে এসে দাঁড়িয়েছে আমার দুই শ্বশুর এবং শাশুড়ি। কারও মুখে কথা নেই। সবাই নিশ্চুপ। যেন আমি অপরাধী। তাই শাস্তি তো আমার প্রাপ্য। তাদের নীরবতায় প্রহারে কিশেনের উৎসাহ যেন আরও বেড়ে গেল। কিশেনের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে গর্জন, ‘তোর ওপর আমাদের পাঁচ ভাইয়ের সমান অধিকার ভাগ করতে চাস কেন? কেন এত স্পর্ধা? মা তো বাবাদের সমান চোখে দেখে? দেখতে পাস না? তুই কি ভাইদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তলেতলে আমাদের জমিন ভাগের মতলব এঁটেছিস?’

আমার ওপর কিশেনের হাত চলতেই থাকে। বাকিরা নিশ্চুপ দর্শক। ঘরের পাশে উনুন জ্বালাবার স্তূপীকৃত গাছের ডাল। কিশেন দৌড়ে গিয়ে একটা ছোট ডাল নিয়ে এসে পেটাতে লাগল আমাকে। আমি যন্ত্রণায় শুয়ে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। অঝোরে কাঁদছি। কিশেন এক সময় গর্জে উঠল, ‘নতুন ঘাগরা পরার জন্য স্বামীদের মধ্যে ভাগাভাগি করা? বাড়ির জমি ভাগের মতলব করা? খোল ঘাগরা।’

আমার পেটের ওপর হাঁটু চেপে কিশেন খুলে ফেলল ঘাগরার ফিতের বাঁধন। পায়ের দিক নীচে টেনে খুলে ফেলল ঘাগরা। পটপট ছিঁড়ে ফেলল কুর্তার সব হুক। ছিঁড়ে গা থেকে খুলে দিল কুর্তা। যেন দ্যূতসভায় দুঃশাসনের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। আমার কোনও কৃষ্ণসখা নেই। লজ্জাহরণ রোধ হল না। স্বামীদের সামনে বিবস্ত্র হতে লজ্জা থাকবে কেন? ভাবখানা এমন। দৃশ্য দেখে আমার দুই শ্বশুরের মুখ নীচু। যেন দ্যূতসভায় পাঞ্চালীর অপমানে আনত মুখে পিতামহ ভীষ্ম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্যরা। আমার শাশুড়ির চোখ ঢাকা আঁচলে। যেন পুত্র দুঃশাসনের অপকর্ম দেখে লজ্জায় চোখ বাঁধা গান্ধারী। এক সময় হাঁপিয়ে উঠে প্রহারে ক্ষান্ত দেয় কিশেন। রান্না ঘরে ঢুকে যায় খেতে। তাকে অনুসরণ করে চার ভাই। আমার দুই শ্বশুরও ঢুকে যায় ঘরে। শাশুড়ি ঘর থেকে আমার শতচ্ছিন্ন ঘাগরা কুর্তা এনে পরিয়ে দেয় আমাকে। পাশে বসিয়ে আমার মাথা নিয়ে নেয় নিজের কাঁধে। চাপা গলায় শাশুড়ি বলতে থাকে, ‘আমি জানি তুই বিরজাকে ঘাগরা আনার কথা বলিসনি। বিরজা নিজেই এনেছে। এই সত্যি কথাটা তুই মুখ ফুটে বলতে পারলি না। কারণ আমি বুঝি তুই বিরজাকে ভালবাসিস। কেন ভালবাসলি? আমাদের জৌনসার বাওয়ারের মেয়েদের কাউকে ভালবাসতে নেই। কারও ভালবাসা তারা পায় না। আমরা শুধু পুরুষদের পণ্য। আমাদের জনগোষ্ঠীর পুরুষরা শুধু ভোগের জন্য বউ নামে মেয়েটিকে ভাগাভাগি করে নেয়। এখানে মেয়েদের কিছু পেতে নেই। বিরজা তোকে পছন্দ করে। তাই ঘাগরা এনেছে। কিন্তু তোকে ভালবাসতে জানে না। কারণ বিরজাও জানে তুই পাঁচ ভাইয়ের সম্পত্তি। তোর ওপর বিরজার পাঁচ ভাগের এক ভাগের বেশি অধিকার নেই। তাই ওর নিজের ইচ্ছেয় ঘাগরা আনার কথা বলতে পারল না।’

আমি শাশুড়ির কথা শুনছি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। শাশুড়ি ফিসফিস করে বলল, ‘তোকে একটা গোপন কথা বলি। আমার দুই স্বামীর মধ্যে ছোটজনকে আমি বেশি ভালবাসি। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারি না। ছোট স্বামী নিজেও আমার ভালবাসার কথা জানে না। বড় ও ছোট দুই স্বামীর কাছেই আমি সমান অধিকারের।’

স্বামীরা খেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরলো। আজ রাতে আমার সঙ্গে থাকার পালা কিশেনের। সে ঢুকল ঘরে চট দিয়ে আড়াল করা অংশে। বাকি চার স্বামী ঢুকে গেল ঘরের বাকি অংশে। আমার ফোঁপান কান্না থামছে না। এক সময় কিশেন এসে দাঁড়াল ঘরের দরজার সামনে। খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করব।’

শাশুড়ি আমাকে ঠেলে দিল কিশেনের দিকে। সারা গায়ে যন্ত্রণা। শরীর চলছে না। কোনওরকমে হেঁটে ঘরে ঢুকলাম। দরজায় খিল এঁটে কিশেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার শরীরের ওপর। কিছুক্ষণ আগে আমার শরীরের ওপর চালিয়েছে উন্মত্ত হিংস্র বীরত্ব। এখন শুরু করল আমার শরীরের ওপর অসহ্য পৌরুষত্ব জাহির। যেন নারী মাংসের ক্ষুধার্ত নেকড়ে। ঘরে তাপ ছড়াতে কড়াইতে আগুন জ্বলছে। তার চেয়ে বেশি দহন আমার শরীর মনে। আগুনে পুড়ে পুড়ে কাঠগুলো কালো কাঠকয়লা হয়ে যাচ্ছে। আমিও যেন বুকের ভেতরের আগুনে পুড়ে পুড়ে হয়ে যাচ্ছি কাঠ কয়লা। প্রতি রাতে এমনি করে পোড়া কাঠ কয়লা হই। পোড়া কাঠ কয়লা হয়েই কেটে যাবে আমার সারা জীবন।

                                                                                          

 অঙ্কন: অনুপ রায়

শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২২